একচিলতে রোদ

0 comments
কনকনে শীত । ঘন কুয়াশায় ঘেরা চারপাশ ,
একটু দুরেই বাঁধা পড়ে দৃষ্টি । তারপর আবার
কুয়াশা । গাঢ় , সাদা কুয়াশা ।
.
হ র র র . . হট . . হট . .
দশটি রুগ্ন পা একসাথে একই ছন্দে চলছে ।
সেই সাথে চলছে রূপালী লাঙল ,

চলছে জীবনের লাঙল . . . .

গরু দুটোর স্বাস্থ্যের অবস্থা খুব খারাপ ,
যতটা ওদের মালিকের । কেমন ঠকঠক
করে কাঁপছে ওরা , যেমনটা কাঁপছে ওদের
মালিকও । ওদের গায়ে যেমন কোন কাপড়
নেই , তেমনি ওদের মালিকের শরীরও প্রায়
পুরোটাই খালি ।
পরনে একটা ছেড়া গামছা চাড়া আর কিছুই
নেই ।




.
কলিম শেখের সম্বল বলতে এই দুটো গাই গরু ,
আর এক টুকরো আবাদি জমি । মাঝেমাঝে গরু
দুটোর জন্য তার খুব মন খারাপ হয় । গরু
দুটোর জীর্নশীর্ন শরীর দেখলে খুব
মায়া লাগে । কলিম শেখের ধারনা তার
শরীর দেখে গরু দুটোরও হয়ত মন খারাপ হয় ,
মায়া হয় । মুখে হয়ত ওরা কিছুই
বলতে পারে না , কিন্তু মাঝেমাঝে কেমন
যেন মলিন দৃষ্টিতে তার
দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা !
.
কিরে ! গায়ে জোর নাই ! খাড়াইলি কেন ?
চল চল , টান লাগা . .
হ র র র . . হট . . হট . .
কলিম শেখ গরু দুটোর সাথে অনবরত
কথা বলে যাচ্ছে , আর গরু দুটো হাল
টেনে চলেছে বিরামহীন । লাঙলের পলায়
জমির বুক চিড়ে খন্ড বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে ।
কলিম শেখ বড় বড় চোখ
করে তাকিয়ে আছে খন্ডিত মাটির
টুকরোগুলোর দিকে । এ যেন মাটি নয় , এক
এক টুকরো স্বপ্ন ।
ধোঁয়াতোলা ধবধবে সাদা ভাতের
স্বপ্ন . . . .
.
কলিম শেখের দুই ছেলে , দুই মেয়ে ।
ছেলে দুটো বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে ।
আর মেয়ে দুটোরও বিয়ে হয়ে গেছে সেই
কবে ।
.
অনেক , অনেকদিন আগে বাবা রজব শেখ
কলিমের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই লাঙল-
জোয়াল । তখন কলিমের বয়স বার কি তের
হবে । দীর্ঘ এতগুলো বছর কলিম শেখ সেই
লাঙ্গল-জোয়ালের ভার বহন করে চলেছেন ।
জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসেও এতটুকু
বিশ্রাম নেই , এতটুকু ক্লান্তি নেই ।
ক্লান্তি হয়ত আছে , কিন্তু
সেটা মেনে নিতে তিনি একেবারেই নারাজ
। তাইতো আজও শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন
জীবনলাঙলের হাতল . . . .
.
ছেলে-মেয়েরা চেড়ে গেলে কি হবে , একজন
কিন্তু এখনো চেড়ে যায় নি কলিম শেখকে ।
যাকে তিনি পষ্ণাশ বছর আগে পেয়েছিলেন
কোন এক ঝড়ের রাতে । সেই রাতের
কথা কলিম শেখের স্মৃতিতে আজও উজ্জল ,
যেন এই সেদিনের কথা . . . .
.
কলিম শেখের বয়স তখন ষোল কি সতের ।
কি যেন এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন রজব
শেখ । বাঁচার কোন আশা নেই আর । একদিন
রাতে তিনি সবাইকে ডেকে বললেন , আজ
রাতেই তার সময় শেষ । মৃত্যুর
আগে তিনি ছেলের বউয়ের মুখ দেখতে চান ।
তাই তাড়াহুড়ো করে সেই রাতেই কলিম
শেখের বিয়ে দেয়া হয় পাশের গ্রামের
“নছিমন বেওয়া ” এর সাথে । নছিমনের
গায়ের রং কিছুটা কালো ছিল । তাই বাসর
রাতে নছিমনকে দেখে কলিম শেখের মুখটাও
কিছুটা কালো হয়ে গেল ।
ততক্ষনে বাহিরের আকাশটাও
কালো হয়ে গিয়েছিল হয়ত । শুরু হল প্রচন্ড
ঝড় । ভোর রাতের দিকে ঝড় থেমে গেল ,
সেই সাথে থেমে গেল রজব শেখের জীবন
প্রদীপও । কি অদ্ভুত ব্যাপার !
লোকটা আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল তার
মৃত্যুর কথা !
.
হ র র র . . হট . . হট . .
কলিমের চোখে পানি । অস্ফুট
স্বরে তিনি বলে উঠলেন , কেমন আছেন
আব্বা . .
তারপর উত্তর দিকের ঐ ঝোপঝাড় ঘেরা পুকুর
পাড়টার দিকে তাকালেন । সেখানেই
ঘুমিয়ে আছেন রজব শেখ গত পষ্ণাশ বছর
ধরে . . . .
.
দীর্ঘ এই জীবনে কলিম শেখ অনেক কিছুই
হারিয়েছেন , অনেকেই
তাকে চেড়ে চলে গেছে । কিন্তু সেই
কালো মেয়েটি আজো রয়ে গেছে তার পাশে ।
কলিম শেখ এবার হাল চেড়ে বসে পড়লেন ।
কুয়াশা তাকে চারপাশ
থেকে ঘিরে ধরেছে যেন । কলিম শেখ
জানেন নছিমন আর বেশী দিন
থাকবে না তার সাথে , যে কোন সময়
চলে যেতে পারে ওপারের ঠিকানায় । গত
পষ্ণাশ বছর ধরে এই কালো মেয়েটাই তার
জীবনকে আলোকিত করে রেখেছিল , সেই
আলো আজ নিভু নিভু ।
.
কলিম শেখ ভেবেই পায় না ,
কিভাবে নছিমন বিহীন
দিনগুলো কাটবে তার । প্রতিদিন
সকালে কে ঘুম ভাঙিয়ে দেবে ? কে পানের
খিলি বানিয়ে দেবে ? কাজ থেকে ফেরার
পর কে শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছে দেবে ?
কে তালপাতার পাখায় ক্লান্তিহীন বাতাস
করে যাবে ? জোছনা রাতে কে চাঁদের বুড়ির
গল্প শুনাবে ? ঘুম না আসলে কে মাথায়
বিনি কেটে দেবে ? ঝড়ের রাতে যখন
বাবার কথা মনে পড়বে , তখন
কে তাকে সান্তনা দেবে ?
.
নছিমনকে চাড়া একটি মুহুর্তও
কল্পনা করতে পারেন না কলিম শেখ । সেই
নছিমন আজ ধীরে ধীরে মৃত্যুর
দিকে এগিয়ে চলেছে , অথচ তার কিছুই
করার নেই . . . .
.
কলিম শেখ
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন . .
গাই দুটো ঘাড় বাকা করে তাকিয়ে আছে তার
দিকে । কি অদ্ভুত ব্যাপার ! গাই দুটোর
চোখগুলোও কেমন ভেজা . . ! !
.
ঐতো সূর্য উঠে গেছে । কুয়াশা কাটতে শুরু
করেছে । নরম রোদে চারপাশটা উজ্জল
হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে । কলিম শেখও
উঠে দাড়ালেন সত্তর ছুঁইছুঁই জরাজীর্ন এক
শরীর নিয়ে । মাটির টুকরোয়
জমে থাকা ফোঁটায় ফোঁটায় শিশির
বিন্দুগুলো শুকাতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে ।
শুকাতে শুরু
করেছে কোঠরে লুকিয়ে থাকা কলিম শেখের
অশ্রুসিক্ত ছোট্ট ছোট্ট চোখ দুটোও ।
.
হ র র র . . হট . . হট . .
স্বপ্ন কখনো মরে না ,
কখনো থেমে থাকে না ।
গরু দুটোর কাঁধে ভর
দিয়ে এগিয়ে চলেছে জোয়াল , লাঙল । সেই
সাথে এগিয়ে চলেছে কলিম শেখের স্বপ্ন ।
নছিমনকে নিয়ে আরও অনেক দিন
বেঁচে থাকার স্বপ্ন . . . .

No comments:

Post a Comment